Шаламов на бенгали, 2019

Jul 28, 2020 15:27

Рассказ "Заклинатель змей" в литературном блоге на бенгальском языке, Бангладеш, Дакка, в переводе Ruma Madok রুমা মোদক и Dipen Bhattacharya দীপেন ভট্টাচার্য. Опубликовано 8 июля 2019 года - সোমবার, ৮ জুলাই, ২০১৯.

ভার্লাম শালামভ'র গল্প : সাপুড়ে

ভার্লাম শালামভের জন্ম ১৯০৭ সনে। ২২ বছর বয়সে, ১৯২৯ সনে, তিনি যখন মস্কো
বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র ছিলেন, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিন বছর কারাভোগের
পরে ১৯৩৭ সনে তাঁকে আবার গ্রেপ্তার করে সাইবেরিয়ার কোলিমার বন্দীশিবির বা গুলাগে
পাঠানো হয়।
দীর্ঘ ১৭ বছর পরে ছাড়া পেলে তাঁর কিছু কবিতা সরকারি পত্রিকায় ছাপা হতে থাকে।
১৯৮২ সনে মারা যান। 'সাপুড়ে' গল্পটি তাঁর 'কোলিমা গল্পগ্রন্থের' একটি গল্প যেখানে
সাইবেরিয়ায় সোভিয়েত শ্রম বন্দীশিবিরের কঠিন জীবন বর্ণিত হয়েছে। এই বইটি
সোভিয়েত ইউনিয়নে প্রকাশিত হয় নি, পশ্চিম ইউরোপে ১৯৬০'এর দশকে পাচার করা
পাণ্ডুলিপি অবলম্বনে জার্মান, ফরাসী ও ইংরেজীতে ছাপা হয়। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী রুশ
লেখক ইভান বুনিন শালামভকে ক্লাসিক রুশ লেখক হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

* * *

ঝড়ে ভেঙে পড়া একটা বিশাল পাইন গাছের ওপর আমরা বসে ছিলাম। এই প্রতিকূল
পারমাফ্রস্টের পৃথিবীতে গাছেরা নিজেদের কোনরকমে দাঁড় করিয়ে রাখে, ঝড় তাদের
সহজেই জমি থেকে আলগা করে দেয়, শিকড় উপড়ে ফেলে মাটিতে শুইয়ে দেয়। প্লাতোনভ
আমাকে তার জীবনের কথা বলছিল, এই পৃথিবীতে আমাদের দ্বিতীয় জীবনের কথা। ঝাংকার
খনির কথা ওঠাতে কিছুটা অজান্তেই আমার ভ্রূকুটি হল। আমি নিজে অনেক কষ্ট্কর কঠিন
জায়গায় থেকেছি, কিন্তু ঝাংকারের দুর্নাম আমাদের জানা ছিল।
‘তুমি সেখানে কতদিন ছিলে?’
'এক বছর,' প্লাতোনড আস্তে বলে। তার চোখদুটো ছোট হয়ে আসে, কপালের ভাঁজগুলো আরো
স্পষ্ট হয়। আমার সামনে প্লাতোনভ হয়ে উঠল অন্য এক প্লাতোনভ, যার বয়স বেড়ে গিয়েছিল
দশ বছর।
'কিন্তু এটা আমাকে স্বীকার করতে হবে যে, শুধুমাত্র প্রথম দিকের দু তিন মাস কঠিন
ছিল। সেখানে একমাত্র আমিই ছিলাম লেখাপড়া জানা মানুষ। ক্যাম্পে বন্দী
দুষ্কৃতিকারীদের কাছে আমি ছিলাম গল্পকথক। আমি তাদের ডুমা, আর্থার কোনান ডোয়েল আর
এইচ জি ওয়েলস এর উপন্যাসগুলোকে কথায় বলতাম। বিনিময়ে তারা আমাকে খেতে দিত,
পোশাক দিত, আমি ভালোই খেতাম সেখানে। তুমিও সম্ভবত তোমার এই লেখাপড়া জানার
গুণটাকে কাজে লাগিয়ে সুযোগ নিয়েছ?'
'না,' আমি বললাম, 'আমি কখনোই খাবারের জন্য 'উপন্যাস' বলতাম না, উপন্যাস কী তাই
আমি জানি না, তবে 'ঔপন্যাসিক' কথাটা আমি শুনেছি।
‘তুমি কি আমাকে দোষ দিচ্ছ?’ প্লাতোনভ জানতে চাইল।
'না, মোটেই তা নয়,' আমি জবাব দিলাম।
'যদি আমি বাঁচি,' প্লাতোনভ বলে সেই একই প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণ করে যখন পরে
দিনটারও অনেক পরের জিনিস নিয়ে আমরা চিন্তা করি, 'আমি এটা নিয়ে একটা গল্প
লিখতে চাই। গল্পটির নামও ঠিক করে রেখেছি। সাপুড়ে। তোমার পছন্দ হয়েছে নামটা?'
'নামটা বেশ। কিন্তু প্রথম কথা হল তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে। সেটাই আসল।'
আন্দ্রেই ফিয়োদোরোভিচ প্লাতোনভ, যিনি তাঁর প্রথম জীবনে ছিলেন একজন চিত্রনাট্যকার,
এই কথোপকথনের তিন সপ্তাহের মধ্যেই মারা যান। মারা গিয়েছিলেন সেভাবেই যেভাবে
অনেকে মারা যায় - গাঁইতি চালিয়ে, হোঁচট খেয়ে, পাথুরে জমির ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে।
ঠিক চিকিৎসা পেলে তাকে হয়ত বাঁচানো যেত, কারণ এক ঘন্টা বা তারো বেশী তিনি
কষ্টকরে শ্বাস নিচ্ছিলেন। কিন্তু যতক্ষণে স্ট্রেচারবাহকেরা এল ততক্ষণে তিনি চুপ হয়ে
গিয়েছিলেন। তারা তাঁর ছোট্ট দেহটিকে মর্গে বয়ে নিয়ে গেল, তিনি তখন ছিলেন একটা
দুর্বল অস্থিচর্মসার দেহ শুধু।
আমি প্লাতোনভকে ভালোবাসতাম, কারণ নীল সাগর আর উঁচু পাহাড়ের জীবন সম্পর্কে তিনি
আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন নি, যদিও সেই জীবন থেকে আমাদেরকে আলাদা করে দেয়া হয়েছিল
বহু মাইল ও বছর দিয়ে। আমরা সেই জীবনের অস্তিত্বকে প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, অথবা
বলা যায় সেই জীবনকে বিশ্বাস করছিলাম ইস্কুল বালকেরা যেমন করে আমেরিকার
অস্তিত্বকে বিশ্বাস করে। প্লাতোনভের কাছে কিছু বই ছিল। ঈশ্বর জানেন কীভাবে, আর
উনি চিরাচরিত কথাবার্তাগুলো এড়িয়ে যেতেন - ডিনারে কী স্যুপ থাকবে কিংবা আমরা
দিনে তিনবার রুটি পাব নাকি সকালেই একবারেই তা দিয়ে দেবে, কালকের আবহাওয়া কি
পরিষ্কার থাকবে এইসব কথা।
আমি প্লাতোনভকে ভালোবাসতাম, এখানে আমি তাঁর 'সাপুড়ে' গল্পটি লেখার চেষ্টা করব।
একটা কাজের দিন শেষ হওয়া মানে এই নয় যে, কাজও শেষ। কাজ শেষে বাঁশী বাজলে,
আামাদের যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে গুদামখানায় যেতে হত, ফেরৎ দিতে হত, লাইন দিয়ে দিনে
দশবার হাজিরা দেবার দুটো 'উপস্থিতি' সম্পন্ন করতে হত, আর এই সমস্ত সময় জুড়ে
প্রহরীরা আমাদের গালিগালাজ করত আর শুনতে হত সেই সমস্ত সহকর্মীদের ক্ষমাহীন
লাঞ্ছনা ও ভর্ৎসনা যারা তখনো আমাদের থেকে শক্ত-সামর্থ ছিল। তারাও ক্লান্ত থাকত,
তাই বাড়ি ফেরার তাগাদায় প্রতিটি মুহূর্তের বিলম্বের জন্য রেগে যেতে। আবার আর একটা
হাজিরা নেয়ার পর আমরা লাইন দিয়ে জ্বালানী কাঠ জোগার করতে বের হতাম। বনে
পৌঁছুতে আমাদের পাঁচ কিলোমিটার হাঁটতে হত, কারণ কাছাকাছি সমস্ত গাছদের কেটে
পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। কাঠুরিয়াদের একটা দ্ল ছিল গাছ কাটার জন্য, কিন্তু খনি
শ্রমিকদের গাছের গুড়িগুলো বহন করে নিয়ে আসতে হত। যে গুড়িগুলো দুজনের জন্যও বহন করা
কঠিন ছিল সেগুলো কী করে নিয়ে আসা হত কে জানে। গুড়িগুলোর জন্য কখনোই ট্রাক পাঠানো
হত না, আর আস্তাবলের ঘোড়াগুলো ছিল খুবই দুর্বল। একটা ঘোড়া একটা মানুষের চাইতেও খুব
তাড়াতাড়ি নির্জীব ও অসুস্থ হয়ে পড়ত। এটা অনেক সময়ই মনে হতে পারে, এবং সম্ভবত
এটা সত্যি যে, মানুষ নিজেকে পশুর জগতের উর্ধে ওঠাতে পেরেছে কারণ তার শারীরিক
সহনশীলতা যে কোনো পশুর চাইতে বেশী। এটা বলা ঠিক নয় যে, মানুষের বিড়ালের মতো
'নয়টি জীবন' আছে, বরং বিড়ালেরা বলতে পারে তাদের নয়টি জীবন রয়েছে - মানুষের
মতোই। একটা ঘোড়া এখানকার শীতের একটা মাসও সহ্য করতে পারবে না যদি তাকে শূন্যের
নিচের তাপমাত্রায় কঠিন পরিশ্রম করানো হয়। তবে এটা সত্যি যে, স্থানীয় ইয়াকুত
জাতিগোষ্ঠীদের ঘোড়াগুলো কাজ করে না, অন্যদিকে তাদের আবার খাবারও দেয়া হয় না।
তারা শীতের রেইনডিয়ার হরিণগুলোর মত গত বছরের শুকনো ঘাস তুষারের নিচ থেকে খুঁড়ে
বের করে। কিন্তু মানুষ জীবন চালিয়ে যায়। হয়তো আশা বলে একটা মানব বৈশিষ্ট্যের
কারণে সে বাঁচে, কিন্তু তার তো কোনো আশা নেই। আত্মসংরক্ষণ করার একটা ইচ্ছা থেকেই
সে নিজেকে বাঁচায়, জীবনকে আঁকড়ে ধরে দুর্বার ইচ্ছায়, বাঁচে সে তার দেহের বাস্তবতায়
যা কিনা তার সমস্ত বৌদ্ধিক চেতনাকে অধস্তন করে রাখে। একটি কুকুর ও পাখি যা খেয়ে
বাঁচে সেভাবে সেও বাঁচতে পারে, কিন্তু সে জীবনকে তাদের চেয়ে আরো ভালভাবে আঁকড়ে
ধরে। যে কোন প্রাণীর তুলনায় তার স্থিতিক্ষমতা অনেক বেশী।
কাঁধে কাঠের গুড়ি নিয়ে হাজিরা দেবার জন্য গেটে দাঁড়িয়ে থাকার সময় প্লাতোনভের
জীবন সম্পর্কে ভাবনাগুলো এরকমই ছিল। মানুষগুলো গুড়িগুলো নিয়ে এসে গাদা করছিল, আর
তারা গুড়ি দিয়ে তৈরি ব্যারাকগুলোয় তাড়াহুড়ো করে, ঠেলাঠেলি করে, গালাগালি করতে
করতে ঢুকছিল।
অন্ধকারে চোখ সয়ে এলে প্লাতোনভ দেখল সবাই যে কাজে গিয়েছিল এমন নয়। সবচেয়ে
দূরের একটা কোনার ওপরের বার্থে , প্রায় সাতটি লোক গোল হয়ে আর তাদের ভেতরে দুজন
তাতারদের ধরণে পা ভাঁজ করে বসে তাস খেলছিল। তাদের কাছে ছিল ঘরের একমাত্র
বাতিটি, একটি কেরোসিন লন্ঠন, যার ধূমায়িত পলতের প্রলম্বিত কম্পিত শিখা তাদের
ছায়াকে দেয়ালে দোলাচ্ছিল।
প্লাতোনভ বাঙ্কের একটা কোনায় বসল। তার কাঁধ আর হাঁটু ব্যথা করছিল, এবং
মাংসপেশীগুলো কাঁপছিল। তাকে সেই সকালেই ঝাংকারে নিয়ে আসা হয়েছে, এটাই ছিল তার
প্রথম কাজের দিন। বাঙ্কের কোথাও খালি জায়গা ছিল না। সে ভাবল, ‘এরা চলে গেলে
আমি একটু শোব।’ সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।
ওপরের বার্থে যখন খেলা শেষ হল, একটি কালো চুল আর গোঁফওয়ালা লোক, যার বাঁ
কনিষ্ঠায় লম্বা নোখ ছিল, বাঙ্কের ধার থেকে মাথা বাড়িয়ে বলে, 'ঠিক আছে, এবার ওই
'ইভানকে' এখানে পাঠিয়ে দাও।'
প্লাতোনভ তার পেছনে একটা ধাক্কা খেয়ে জেগে গেল।
'তারা তোমাকে ডাকছে।'
'ওই ইভানটা গেল কোথায়?' ওপরের বাঙ্ক থেকে কে যেন চিৎকার করে।
'আমার নাম তো ইভান নয়,' প্লাতোনভ চোখ কুঁচকে বলে।
‘ও যাচ্ছে না, ফেদিয়া!’
‘যাচ্ছে না মানে কী?’
প্লাতোনভকে আলোতে ঠেলে দেয়া হয়।
‘তোমার কী বেঁচে থাকার ইচ্ছা আছে?’ ফেদিয়া তার নোংরা নখের কনিষ্ঠা প্লাতোনভের
চোখের সামনে নাচিয়ে আস্তে জিজ্ঞেস করল।
‘তাই তো আমার পরিকল্পনা,’ প্লাতোনভ উত্তর দিল।
তার মুখাবয়বে একটা জোর মুষ্ট্যাঘাতে সে মাটিতে পড়ে গেল। সে উঠে দাঁড়ায়, জামার
আস্তিনা রক্ত মোছে।
'এটা কোনো উত্তর হল,' শান্ত স্বরে বলল ফেদিয়া, ‘আমি বিশ্বাস করতে পারছি না
তোমাকে কলেজে এভাবে উত্তর দিতে শিখিয়েছে, ইভান।’
প্লাতোনভ চুপ করে থাকে।
'ওখানে যাও, হতচ্ছারা,' ফেদিয়া বলল, 'পায়খানার বালতির পাশে শুয়ে পড়। এখন থেকে
ওটাই তোমার জায়গা। আর যদি তুমি কোনো ঝামেলা কর, তোমার টুঁটি চেপে ধরব।’ এই
হুমকিটি অর্থহীন ছিল না। এই চোরেদের হিসেব নিকেশের সময়, প্লাতোনভ ইতিমধ্যে
দু'জনকে দেখেছে, যাদেরকে তোয়ালে দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে। প্লাতোনভ
গন্ধময় জায়গায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।
‘কী বিরক্তিকর, বন্ধুরা!’ ফেদিয়ে বলে হাই তুলতে তুলতে, ‘হয়তো আমার কাউকে দরকার
যে আমার গোড়ালি চুলকে দেবে....’
'মাশকা, এই মাশকা, ফেদিয়ার গোড়ালি চুলকে দাও।'
মাশকা, একটি বিবর্ণ-সাদা সুন্দর ছেলে, আলোর ছটার মধ্যে বের হয়ে আসে। সে ছিল
একটি অল্পবয়স্ক চোর, বছর আঠারো বয়সের।
সে ফেদিয়ার ব্যবহারে দীর্ণ হলুদ বুটজোড়া টেনে বার করে, সাবধানে তার নোংরা ছেঁড়া
মোজাগুলো খুলে ফেলে, তারপর মুখে স্মিত হাসি নিয়ে ফেদিয়ার গোড়ালি চুলকে দিতে
থাকে। ফেদিয়া খিলখিল করে হাসে, সুড়সুড়িতে তার শরীর মোচড়ায়।
‘এখান থেকে যাও,’ হঠাৎ ফেদিয়া বলে, ‘তুমি জানো না কী করে সুড়সুড়ি দিতে হয়।'
‘কিন্তু ফেদিয়া, আমি....'
'যাও এখন, আমি বলছি। তুমি শুধু আঁচড়ে দিতে জান, কোনো কোমলতা নেই।'
আশেপাশের লোকেরা সহানুভূতির সাথে তাদের মাথা নাড়ায়।
‘কোসয়তে আমার একজন ইহুদী ছিল, সে জানত কীভাবে চুলকাতে হয়। ও বাবা, সে জানত
কেমন করে চুলকাতে হয়। সে এক্জন প্রকৌশলী ছিল।'
ফেদিয়া সেই ইহুদী প্রকৌশলী, যে গোড়ালি চুলকে দিত, তার সম্বন্ধে ভেবে চিন্তামগ্ন
হয়ে গেল।
‘ফেদিয়া, ফেদিয়া, ওই নতুন লোকটি কেমন? তুমি ওকে দিয়ে একটু চেষ্টা করে দেখ না।’
'ওই ধরণের মানুষ চুলকাতে জানে না,' ফেদিয়া বলে, ‘তবুও ওকে জাগাও।’ প্লাতোনভকে
আলোতে নিয়ে আসা হল।
ফেদিয়া বলল, ‘লন্ঠনটা ঠিক কর, ইভান। তোমার কাজ হল রাতে আগুনে কাঠ দেয়া আর
সকালে বালতিটা বাইরে নিয়ে যাওয়া। আর্দালি তোমাকে দেখিয়ে দেব কোথায় ময়লা
ফেলতে হবে...’
প্লাতোনভ বাধ্য ছেলের মতো চুপ করে থাকে।
‘বিনিময়ে, তুমি এক বাটি স্যুপ পাবে,' ফেদিয়া বলল, 'আমি এই আবর্জনা খেতে পারি
না। ঠিক আছে, তুমি এখন ঘুমাতে যাও।’
প্লাতোনভ তার আগের জায়গায় শুয়ে পড়ল। প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল, দু ইবা তিনজনের
দল হয়ে কারণ সেভাবে একটু গরম থাকা যায়।
‘এমন একটা একঘেয়ে বিরক্তিকর সময় যে আমার পাগুলো লম্বা হয়ে যাচ্ছে। যদি কেউ
আমাকে একটা উপন্যাস শোনাতে পারত। কোসয়ে যখন ছিলাম...’
‘ফেদিয়া, এই ফেদিয়া, নতুন মানুষটাকে দিয়ে চেষ্টা কর না কেন?’
'এটা একটা আইডিয়া,' ফেদিয়া যেন প্রাণ পেল, ‘ওকে জাগিয়ে দাও।’
প্লাতোনভকে জাগানো হল।
'শোনো,' ফেদিয়ার গলা একেবারে খোশামুদে, ‘আমি এর আগে একটু বেশী কথা বলে
ফেলেছিলাম।’
‘সেটা ঠিক আছে,’ দাঁতে দাঁত চেপে বলে প্লাতোনভ।
‘শোনো, তুমি কী উপন্যাস বলতে পার?’
প্লাতোনভের মুখমণ্ডলে কিছু একটা খেলে যায়। অবশ্যই, সে পারবে। তাদের বিচারকার্য শুরু
হবার অপেক্ষায় বন্দীশালার মানুষদের সে কাউন্ট ড্রাকুলা শুনিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ করে
রেখেছিল। কিন্তু তারা তো সেখানে সব মানুষ ছিল। আর এখানে? সে কি মিলানের ডিউকের
রাজসভার ভাঁড় হবে, যে ভাঁড় ভাল রসিকতা করলে খেতে পেত আর কৌতুক খারাপ হলে মার
খেত? কিন্তু বিষয়টাকে অন্যভাবে দেখা যেতে পারে; সে এদেরকে সত্যিকারের সাহিত্যর
সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারে, সে হতে পারে আলোকবর্তিকা। এমন কি এখানে, জীবনের
সর্বনিম্ন এই তলায়, সে এদের মধ্যে সাহিত্য জগতের প্রতি আগ্রহ জাগাতে পারে।
প্লাতোনভ কিছুতেই এটা মানতে পারল না যে, সে খেতে পাবে এক পাত্র বাড়তি স্যুপ
ময়লার বালতিটা বাইরে নিয়ে যাবার জন্য নয়, বরং ভিন্ন একটা মহত্তর কাজের জন্য।
কিন্তু সত্যিই কি তা মহৎ? শেষ পর্যন্ত এটা তো একটা চোরের নোংরা গোড়ালি চুলকে
দেবার মতই, জ্ঞানালোক বিতরণ নয়।
ফেদিয়ার হাসিতে যেন উদ্দেশ্য ছিল, সে একটা উত্তরের জন্য অপেক্ষা করছিল।
‘আমি পারব,’ প্লাতোনভ তোতলায়, আর তারপর প্রথমবারের মত সেই কঠিন দিনে স্মিত
হাসি হাসে, 'আমি পারব।'
'ও ভাই,' ফেদিয়া আরো প্রসন্ন হয়, 'এসো, এদিকে উঠে এসো, কিছু রুটি নাও। কালকে
তুমি আরো ভাল খাবার পাবে। এই যে এই কম্বলের ওপর বস। ধূমপান করো।'
প্লাতোনভ এক সপ্তাহ সিগারেটে টান দেয় নি, ঘরে তৈরি তামাকের বিড়ি ফুঁকে তার খুব
সুখ হয়।
‘তোমার নাম কি?’
‘আন্দ্রেই,’ প্লাতোনভ উত্তর দেয়।
‘শোনো, আন্দ্রেই, বড় আর মজার কিছু একটা বল। 'কাউন্ট অফ মনটেক্রিস্টোর' মত কিছু
একটা, কিন্তু গরাদ-টরাদ যেন না থাকে তাতে।’
'হয়ত রোমান্টিক কিছু একটা?' প্লাতোনভ সুপারিশ করে।
‘তার মানে তো 'জ্যাঁ ভালজ্যাঁ' ? কসোয়তে আমি সেটা শুনেছি।’
‘কিংবা 'ক্লাব অফ ব্ল্যাক জ্যাকস'? অথবা 'ভ্যাম্পয়ার'?’
‘বাহ, চমৎকার। 'ব্ল্যাক জ্যাকসই' হোক। এই হতচ্ছারারা, তোমরা চুপ কর' চিৎকার করে
ফেদিয়া।
প্লাতোনভ কাশে।
'সেন্ট পিটার্সবার্গ শহরে, আঠারোশ তিরানব্বই সনে একটি রহস্যময় অপরাধ ঘটেছিল.....
যখন প্রায় ভোর হয়ে এল তখন প্লাতোনভ অনুভব করল সে আর পারছে না।
সে বলল, ‘প্রথম অংশে সবে শেষ হল।’
‘বাহ, বেশ হল,' ফেদিয়া বলল, 'এখানে আমাদের সাথে শুয়ে পড়। তুমি ঘুমানোর জন্য
যথেষ্ট সময় পাবে না; প্রায় ভোর হয়ে গেছে। বরং কাজে গিয়ে কিছু ঘুমাতে পারবে। আজ
সন্ধ্যার জন্য শক্তি সঞ্চয় কর.....।’
প্লাতোনভ ঘুমিয়ে পড়ল।
তাদের যখন কাজে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল গাঁয়ের লম্বা মতন একটি ছেলে, যে কিনা গতরাতে
জ্যাকস গল্প বলার সময় ঘুমাচ্ছিল, প্লাতোনভকে দরজার মধ্য দিয়ে বাজেভাবে ধাক্কা দিয়ে
বলল, ‘এই শুয়োর, দেখছ না কোথায় যাচ্ছ?'
তখনই কেউ এসে ছেলেটির কানে ফিসফিস করে কী যেন বলল।
যখন তারা লাইন দিচ্ছিল, লম্বা ছেলেটি প্লাতোনভের কাছে এল।
‘দয়া করে ফেদিয়াকে বলো না যে, আমি তোমাকে ধাক্কা দিয়েছি। ভাই, আমি জানতাম না
যে, তুমি একজন ঔপন্যাসিক।’
‘আমি বলব না,’ প্লাতোনভ বলল।

переводы, Варлам Шаламов, "Колымские рассказы", Азия

Previous post Next post
Up